মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টন বা কে কতটুকু সম্পত্তি পায়

উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টন

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “উত্তরাধিকার আইন নিজে জানো ও অপরকে শেখাও, সকল জ্ঞানের অর্ধেক হল এই জ্ঞান।” তবে অনেক মুসলমানেরই উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। মুসলিম আইনে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার ওপর ভিত্তি করে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, যা ফারায়েজ নামে পরিচিত।

Table of Contents

সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বের আনুষ্ঠানিকতা:

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি বণ্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়:

  • মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের খরচ তার সম্পত্তি থেকে মেটাতে হবে।
  • জীবিত অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ধার-দেনা থাকলে তা পরিশোধ করতে হবে।
  • স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।
  • মৃত ব্যক্তির করা দান বা উইল অনুযায়ী প্রাপককে দিয়ে দিতে হবে।

উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তির বণ্টন:

উপরে উল্লিখিত আনুষ্ঠানিকতাগুলি সম্পন্ন করার পর মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। এখানে প্রধান কিছু অংশীদারের সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম তুলে ধরা হল:

১. স্বামীর অংশ:

  • স্ত্রী যদি সন্তান বা নাতি রেখে মারা যান, তবে স্বামী পাবেন ১/৪ অংশ।
  • সন্তান বা নাতি না থাকলে স্বামী পাবেন ১/২ অংশ।

২. স্ত্রীর অংশ:

  • স্বামীর সন্তান বা নাতি থাকলে স্ত্রী পাবেন ১/৮ অংশ।
  • সন্তান বা নাতি না থাকলে স্ত্রী পাবেন ১/৪ অংশ। স্ত্রী একাধিক হলে সকল স্ত্রীরা মিলে সমানভাবে ১/৪ অংশ পাবেন।

৩. বাবার অংশ:

  • সন্তানের পুত্র বা নাতি থাকলে বাবা পাবেন ১/৬ অংশ।
  • কন্যা সন্তান থাকলে বা নাতনি থাকলে বাবা পাবেন ১/৬ অংশ।
  • পুত্র বা কন্যা না থাকলে, অন্যান্য অংশীদারের অংশ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সব সম্পত্তি পাবেন বাবা।

৪. মায়ের অংশ:

  • সন্তান বা নাতি থাকলে বা ভাইবোন থাকলে মা পাবেন ১/৬ অংশ।
  • সন্তান বা নাতি না থাকলে এবং একজনের বেশি ভাইবোন না থাকলে মা পাবেন ১/৩ অংশ।
  • স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট ১/৩ অংশ পাবেন।

৫.পুত্র সন্তানের অংশ:

  • মাতা-পিতা ও স্বামী-স্ত্রী নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার পর, অবশিষ্ট সম্পত্তি পুত্র-কন্যার মধ্যে বণ্টন হবে। পুত্ররা কন্যাদের দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে।
  • মেয়ে না থাকলে, অবশিষ্ট সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে বণ্টিত হবে।

৬. কন্যা সন্তানের অংশ:

  • একমাত্র কন্যা হলে ১/২ অংশ পাবেন।
  • একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাগে ২/৩ অংশ পাবেন।
  • পুত্র থাকলে, পুত্র-কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়মাবলী:

  • সন্তান বা বাবা না থাকলে, জীবিত ভাই বা ভাইয়ের সন্তানেরা সম্পত্তি পাবে।
  • কোন সন্তানকে ত্যাজ্য ধরা হয় না, ফলে সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না।
  • রেজিস্ট্রিকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করলে সন্তান সম্পত্তি পাবে না।
  • সৎ সন্তান, সৎ বাবা বা মা, এবং জারজ সন্তান মুসলিম হানাফী আইন অনুসারে সম্পত্তি পাবে না।
  • হত্যা করলে হত্যাকারী উত্তরাধিকারী হবে না।
  • বিবাহ বিচ্ছেদের পর কেউ কারো সম্পত্তি পাবে না।
  • মৃত ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকার না থাকলে সরকার তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।

প্রাপ্য অংশগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

সন্তানদের প্রাপ্য অংশ:

সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টনে মুসলিম আইন অত্যন্ত স্পষ্ট। এখানে পুরুষ সন্তান এবং নারী সন্তানের প্রাপ্য অংশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ সন্তানরা নারীদের দ্বিগুণ অংশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি মৃত ব্যক্তির একজন পুত্র এবং একজন কন্যা থাকে, তবে পুত্রের প্রাপ্য হবে কন্যার দ্বিগুণ।

ভাইবোনদের প্রাপ্য অংশ:

যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান বা পিতা-মাতা কেউ না থাকে, তাহলে ভাইবোনেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। ভাইবোনদের ক্ষেত্রেও পুরুষ এবং নারীর প্রাপ্য অংশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

সন্তান না থাকলে মা-বাবার প্রাপ্য অংশ:

যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে, তাহলে তার মা-বাবা সম্পত্তির প্রধান উত্তরাধিকারী হন। এই ক্ষেত্রে মাতা-পিতার প্রাপ্য অংশ বেশি হয়ে থাকে।

সম্পত্তির জটিলতা ও সমস্যা সমাধান:

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন খুব স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে সম্পত্তি বণ্টনে জটিলতা দেখা দেয়। এ কারণে অনেকেই বিভিন্ন আইনি জটিলতায় পড়েন। এসব জটিলতা দূর করতে কিছু পরামর্শ:

১. সঠিক আইনি পরামর্শ: উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে ভালভাবে জেনে এবং আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে সম্পত্তি বণ্টন করা উচিত।
২. পারিবারিক আলোচনা: সম্পত্তি বণ্টনের আগে পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
৩. দলিলপত্র সংরক্ষণ: সম্পত্তির সকল দলিলপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা উচিত যাতে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা না হয়।
৪. আইনানুযায়ী উইল তৈরি: জীবিত অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে আইনি উইল তৈরি করা উচিত।

উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টন
উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টন

শেষ কথাঃ

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টনের নিয়মগুলি জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরি। এই আইন মেনে চললে পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত থাকে এবং সম্পত্তি নিয়ে কোন বিরোধ দেখা দেয় না। ফারায়েজের নিয়মগুলি যথাযথভাবে পালন করলে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার প্রকৃত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টিত হয় এবং এর ফলে সম্পত্তি নিয়ে কোন জটিলতা থাকে না।

আশা করি, এই আলোচনা থেকে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে এবং এর মাধ্যমে পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে। এছাড়া, মুসলিম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আরও বিস্তারিত জানার জন্য বিভিন্ন ইসলামিক বই ও ইসলামিক স্কলারদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

পরামর্শমূলক কথাঃ

১. কুরআন ও হাদিসে দৃষ্টিভঙ্গি: মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করুন।
২. স্থানীয় আইনজীবীর পরামর্শ: নিজের দেশে প্রযোজ্য আইন সম্পর্কে জানতে স্থানীয় আইনজীবীর পরামর্শ নিন।
৩. অনলাইন রিসোর্স: অনলাইনে বিভিন্ন ইসলামিক ওয়েবসাইটে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোও অনুসন্ধান করতে পারেন।
৪. শিক্ষামূলক সেমিনার: বিভিন্ন ইসলামিক সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে আরও জানতে পারেন।

FAQ’S

১। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোন কোন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়?

উত্তরঃ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টন করা জন্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়।

২। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনে কী কী গুরুত্বপূর্ণ দরকার?

উত্তরঃ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনে তার আইনগত প্রেফারেন্স, বিভাগীয় সম্পত্তির ব্যবস্থা, বিভাগীয় বৈবাহিক অধিকার, ও আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্বপূর্ণ।

৩। পুরুষ এবং নারী সন্তানের সম্পত্তি বণ্টনে কী প্রয়োজন?

উত্তরঃ পুরুষ এবং নারী সন্তানের সম্পত্তি বণ্টনে তাদের সমতুল্য অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার বিবেচনা করা প্রয়োজন।

৪। মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে সম্পত্তির বণ্টনে কী হয়?

উত্তরঃ মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে তার সম্পত্তি আইনগতভাবে বিভাজন হয়ে থাকে।

৫। সম্পত্তি বণ্টনের প্রধান আইনি নিয়মগুলি কী?


উত্তরঃ সম্পত্তি বণ্টনের প্রধান আইনি নিয়মগুলি ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় পছন্দ, সন্তানের অধিকার, ও উইল ইত্যাদি সম্পর্কে বিবেচনা করে।

৬। আইনানুযায়ী উইল কি এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?


উত্তরঃ উইল হলো ব্যক্তির অধিকারগুলির সঠিক পরিপাটি সম্পর্কে নির্দেশ করার একটি নথি, যা ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর।

৭। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী কোন কোন সমস্যা সমাধান করা যায়?

উত্তরঃ মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টন, উইল তৈরি, পুনর্বিবাহ, ও সম্পত্তির জটিলতা সমাধান করা যায়।

Leave a Comment

Leave a Comment